Prose Details
ses sambal
শেষ সম্বল
বাইরের দরজাটা একঘেয়ে শব্দে জোরে জোরে ধাক্কা খেয়েই চলেছে- ঠিক করে বোধহয় বন্ধ করা হয়নি। বেখেয়ালেই ঘুম থেকে উঠে অর্ক সেটা বন্ধ করতে যায়, কিন্তু তৎক্ষণাৎ তার মনে পড়ে আর দরকার নেই । এখানে আর মাত্র এক ঘণ্টা সময় বাকি আছে। যে সমস্ত জিনিসগুলো এতদিন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হত আজ তাদেরকে অবহেলায় উপেক্ষা করা যেতে পারে।
সচেতন হয়েই সে আর দেরি না করে পাগলের মত এ ঘর ও ঘর ছুটে বেড়াতে থাকে, নেড়েচেড়ে এটা ছুঁয়ে, ওটা ছুঁয়ে, কেটে যায় আরও দশ মিনিট। শেষে পরাস্ত সৈনিকের মত সে বসে পড়ে মেঝেতে আর প্রায় এক যুগ বাদে হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করে।
বেশ কিছু মাস ধরেই ঘোষণা চলছে খুব জোরে। বিশ্ব প্রযুক্তিগত প্রতিষ্ঠান, বিশ্ব মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র, বিশ্ব পরিবেশ সচেতক সংস্থা- সবাই মিলে কিছু ভাগ্যবান মানুষের নাম, দিন, তারিখ ঘোষণা করে চলেছে বারবার । অবিশ্বাস্যভাবে অর্ক সেনের নামও তার মধ্যে আছে। হাতে তার আর মাত্র একটি কাজই বাকি, বাকি সব হয়ে গেছে।
ভগবানকে আর একবার ধন্যবাদ জানায় সে তার দায়বদ্ধতাহীন এই অবিবাহিত অবস্থার জন্য। সত্যি কথা বলতে কি, খুব প্রয়োজন বোধও করেনি কখনো সে বিয়ে করার জন্য। তার বাবা মাও তার মতকে স্বাগত জানিয়েছেন সবসময়। যদিও সে কখনই ব্রম্ভচর্যে বিশ্বাস করেনি। অসংখ্য প্রেম এবং অসংখ্য সম্পর্ক যার প্রমাণ দেবে। কারণ যৌন সম্পর্কের জন্য ছাড়পত্রের প্রয়োজন পড়ে না। আর সন্তান সে কোনদিনই চায় নি।তার যুক্তি ছিল পৃথিবীতে ইতিমধ্যেই অনেক মানুষ আছে, আর না বাড়ালেও চলবে।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক অর্ক পাড়ার ব্যঙ্কের সামনে লাইনের শেষে গিয়ে দাঁড়ায়। আজকাল ব্যঙ্কের ভূমিকা এতো পালটে গেছে যে ভাবাই যায় না যে এখান থেকে আগে লোকে টাকা তুলত। কারণ এখন টাকা দিয়ে সেখান থেকেই জিনিস কেনা যায়। ‘টাকা’ কি অদ্ভুত এক জিনিস। এক অজানা অনুভুতি বয়ে যায় তার শরীর দিয়ে। আর কিছুক্ষণ পরে তার আর প্রয়োজন থাকবে না এই টাকার। কিন্তু এই পুরনো পৃথিবীতে এখনও তার ভীষণ প্রয়োজন। শুধু বড়লোকের হাতে বেশি টাকা, গরিবের হাতে কম টাকা আছে ।
তার নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়, যখন সব কিছু স্বাভাবিক ছিল। যদিও বয়স বেড়ে বেড়ে একদিন মরে যাওয়াকে যদি স্বাভাবিক বলে ধরা হয় । এইভাবেই চলছিল ২০৩০ অবধি। তার আগে ২০২০ এর মহামারি বাদ দিলে মোটামুটি সবাই মাস্ক ছাড়া হাঁটতে পারত, দোকান বাজার খোলা থাকতো, দেশ ভ্রমণের আনন্দ ছিল। পৃথিবীটা অনেক দেশে বিভক্ত ছিল। তারপর ধীরে ধীরে সব হাতের বাইরে চলে গেল। প্রশাসনব্যবস্থা ভয় পেতে শুরু করল, বিজ্ঞানীরা পাগল হয়ে গেল, আর সাধারণ মানুষ হয়ে গেল মূল্যহীন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ এক রোজকার ঘটনা হয়ে গেল। আর তার থেকেও দ্রুত পালটাতে লাগল মানুষের মন। ছোটো দুর্ঘটনা, কারুর মৃত্যু তাদেরকে আর তেমনভাবে নাড়া দিত না। জনসংখ্যা এমন ভয়াবহ বৃদ্ধি পেল যে একমাত্র কোন অলৌকিক ঘটনাই তাকে কমাতে পারত । তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ল দূষণ। কবে থেকে যেন মাস্ক পড়া ছাড়া আর উপায় রইলো না। জীবন পুরো পালটে গেল জলের অভাবে। স্নানের সংজ্ঞা উঠে গেল, রান্নার আর দরকার ছিল না স্বাস্থ্য বড়ির আগমনে । কিন্তু সে ছিল অন্য এক সময়ের সূচনা মাত্র। সব ওলটপালট হয় আরও অনেক পরে । কারণ তখনো সাধারণ মানুষ তাদের পুরনো অভ্যাস ছাড়তে পারেনি। নতুন নিয়ম বাইরে মানলেও, দরজা জানলা বন্ধ করে, চার দেওয়ালের মধ্যে, তারা আবার ফিরে যেত তাদের অস্বাভাবিক, কিন্তু স্বাভাবিক জীবনের ছন্দে।
অর্কর সব মনে আছে।ছোটো ছোটো সব পুরনো গল্প তার মনে আছে। ছোটো থেকেই তার বাবা মার কাছে পুরনো গল্প শুনতে খুব ভালো লাগতো তার । এখন তার মনে হয় তার ইতিহাস প্রীতি বোধহয় সেখান থেকেই শুরু।পুরানো সমাজ, পুরানো জীবন, পুরানো পৃথিবী- তাকে খুব টানে। কিন্তু আজ এই ২০৪০ এ এসে সেই ছোটবেলা, সেই স্কুল, সেই ইতিহাস পড়া এবং পড়ানো, সব কত দূরে মনে হয়। আজ মাত্র ৩৫ বছর বয়েসে সে একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। এমন নয় যে সে পড়াতে আর আগ্রহী নয় বা পড়ানোর আর কোন বিষয়বস্তু নেই। আসলে ‘ইতিহাস’ এই বিষয়টি পড়ানোর আর প্রয়োজন নেই। সারা পৃথিবীর ইতিহাস আজ প্রতিটি ছাত্র, প্রতিটি মানুষের নিজস্ব ইলেক্ট্রনিক ইউনিট বা ‘আই’ এ ঢোকান আছে। তার জন্য শিক্ষকের আর দরকার নেই। তার বাবা মা আমৃত্যু চিন্তিত ছিলেন তার ভবিষ্যৎ নিয়ে, তার ইতিহাস কে বিষয় হিসেবে বেছে নেয়া নিয়ে । কিন্তু তারা জানতেন না ভাগ্য তার জন্য অন্য গল্প লিখছে।
কাউনটারে ‘বিপ’ শব্দ শুনে আবার চমকে বর্তমানে ফিরে আসে অর্ক। ট্রেতে টাকা দিয়ে সে একদিনের মত খাদ্য বড়ি আর দুই বোতল অক্সিজেন নিয়ে নেয়। একবার ভাবে পাঁচ বোতল নেবে কিনা। কিন্তু তারপরেই তার মনে পড়ে কালকে থেকে এগুলো আবর্জনা হয়ে যাবে। ফেরার পথে তার চিত্রার সঙ্গে দেখা হয়। চিত্রার সঙ্গে সে অনেকদিন আগে এক সুন্দর সময় কাটিয়েছিল। যে কলেজে সে ইতিহাস পড়াতো সেখানেই চিত্রা সঙ্গীত শিক্ষিকা ছিল। বস্তুত চিত্রাই তার জীবনের প্রথম প্রেম। যদিও সে অনেকদিন আগের কথা। সে সম্পর্ক ভেঙ্গেছে বছর কয়েক পরেই, যদিও দুজনের সম্পর্ক তারপরেও বন্ধুত্বের। আজ কিন্তু চিত্রা তাকে দেখে তাড়াতাড়ি পাশ কাটিয়ে চলে গেল। অর্ক তাতেই কৃতজ্ঞ বোধ করে। অন্তত চিত্রা আর সবার মত ঝাঁপিয়ে পড়েনি তার উপর। নিজেকে হঠাৎ বিশ্বাসঘাতক বলে মনে হয় তার এই সমাজ, তার পরিচিত জন, এমনকি পুরো মানবজাতির প্রতি।ছুটে বাড়ি ফিরে দরজা বন্ধ করে সে।
মাত্র এক বছর আগে আচমকাই একদিন তার মাথায় বাজ পড়ে যখন সে তার চাকরির টারমিনেসন এর চিঠিটা পায় ‘আই’ তে। চুপ করে বসে থাকে অনেকক্ষণ। কিছুদিন থেকেই তার মনে হচ্ছিল এটা আসতে চলেছে।তবু হাতে পেয়ে তার মনে হয় সে এটার জন্য প্রস্তুত নয়। সবার প্রথমে যেটা নিয়ে ভয় হয় সেটা হল টাকা। এই অবস্থায় সে টাকা ছাড়া চালাবে কি করে। যেখানে বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন কিনতে হয় টাকা দিয়ে সেখানে সে কদিন চালাতে পারবে?আর খাবার জলের প্যকেটও প্রায় শেষ বাড়িতে, যা নাকি খাদ্য বড়ির থেকেও দুর্মূল্য। তার সঞ্চয় দিয়ে সে হয়ত আর এক মাস কোনমতে বেঁচে থাকতে পারবে, কিন্তু তারপর? শুধু এগুলো সব ঠিক হয়ে যেতে পারে, যদি সে কোন রকমভাবে একবার এই পৃথিবীর বাইরে যেতে পারে। কিন্তু সে সম্ভাবনা নেই। পৃথিবীর বাইরে যেতে পারে শুধু বিজ্ঞানীরা, বড় ব্যবসায়ীরা বা বিখ্যাত লোকেরা। তার মত সাধারণ মানুষের কোন সম্ভাবনাই নেই যাবার।সাধারণ জীবন, সাধারণ পটভূমির, সাধারণ জায়গার এক সাধারণ মানুষ।এখন আর পৃথিবী দেশে বিভক্ত নয়। সব মানুষের পরিচয় তার ‘আই’ তে আবদ্ধ একটি সংখ্যার দ্বারা। পৃথিবীতে আর কিছু বিনামূল্যে পাওয়া যায় না। জীবনের অত্যাবশ্যক জিনিস কিনতে হয় টাকা দিয়ে। তবে সাধারণ মানুষের পক্ষে তাও ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে অগুনতি জীবিকা বিলুপ্ত হয়ে যাবার জন্য।
আসলে সেই সব সাধারণ মানুষ শুধুমাত্র অর্থহীন হয়নি, তারা হয়ে উঠেছে মনুষ্যত্বহীনও। মানুষে মানুষে হিংসা, হানাহানি, স্বার্থপরতা সীমা ছাড়িয়ে গেছে। কোন সম্পর্কই জোরালো নয়। বিভ্রান্ত মানুষ শুধু একটা দিন আর বেঁচে থাকার জন্য লড়াই চালাচ্ছে রোজ নিজের রক্তের সম্পর্কের সঙ্গেও। পৃথিবীর মাটিতে এক অদ্ভুত জীব সৃষ্টি হয়েছে যেন।সেও সেই দলের একজন হয়ে যাবে ভেবে অর্কর ভয়ে বুক কেঁপে উঠল। তাও ভালো, বাড়িতে তার মুখ চেয়ে কেউ বসে নেই। তার কাছের বলতে আছে তার পুরনো কুকুর ব্রুনো ।কিন্তু সেও ফুসফুসের সঙ্ক্রমণে মৃত্যুপথযাত্রী। বিষাক্ত বায়ু তাকে বেশিদিন আর টানতে হবে না। কিন্তু তার নিজের দিন চলবে কি করে। যে প্রতিবেশীরা আজ তার সঙ্গে কথা বলছে, তার বেকারত্বর কথা শুনলে আর এমুখো হবে না। কারণ এখন সবাই জানে খাদ্য, জল ছাড়া এক সাধারণ, নিরীহ মানুষও কি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে।সে তার ‘আই’ খুলে দ্যাখে আর কত টাকা আছে তার। তারপর বৃদ্ধদের মতন ধীর পায়ে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। বহুক্ষণ পর্যন্ত তার ঘুম আসে না।
তবু পরের দিন সকালে সে দৃঢ় সঙ্কল্প হয়ে তার কলেজে আর একবার যায়। সেখানে তার সব সনাক্তকরণ এবং বিশুদ্ধিকরণ হয়ে গেলে, তাদের কনফারেন্স রুমের বড় মনিটরে সে তার ‘আই’ সংখ্যা দিয়ে ঢুকে তার বক্তব্য পেশ করে। কিন্তু কিছু লাভ হয়না । সে বোঝে যন্ত্রের যুক্তি একজন মানুষের থেকে অনেক ভালো। হতভাগ্য ‘পৃথিবীবাসী’দের (হ্যাঁ, এই নামেই ডাকা হয় সেই মানুষদের যাদের এখান থেকে আর কোথাও যাবার নেই) দলে আর একজন মরিয়া মানুষ বাড়লে কারুর কিছু এসে যায় না।
তার পরের দিনগুলো ঝাপসা অর্কর কাছে। কখন একটা দিন শুরু হয়েছে, আর কখন শেষ হয়েছে তা তার মনে নেই। তার ‘আই’ একেবারে চুপ হয়ে গিয়েছিলো। কারুর তাকে নিয়ে ভাবনা ছিল না। হাজারে হাজারে ‘পৃথিবীবাসী’দের মতন সেও একটা বোঝা হয়ে গিয়েছিল সবার কাছে। যার সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করতে চায় নি।বাড়ির চেনা পরিবেশ, চেনা বিছানা, চেনা বই, চেনা ফটো কিছুতেই যেন তার মনের ভার কমছিল না। তার নিষ্ক্রিয় ‘আই’ কে পাশে রেখে সারাদিন সেও একই রকম ভাবে বিছানায় শুয়ে কাটিয়ে দিত । এইভাবেই হঠাৎ একদিন একটা সবুজ আলো জ্বলে উঠল তার ‘আই’ তে। আর এক যান্ত্রিক স্বর তার সঙ্গে কথা বলল।
************************************************
নির্বাচিত যে মানুষরা প্রথম মহাকাশযানে ওঠার অনুমতি পেয়েছিল তারা সবাই নয় বিজ্ঞানী আর নয়ত বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বরা । কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই নাটকীয়ভাবে সব কিছু ওলটপালট হয়ে গেলো। যাবার জন্য নিয়ম পালটাতে লাগল প্রতিদিন।যারা পৃথিবীর বাইরে জায়গা পেল তারা পৃথিবীবাসীদের জানাতে লাগল তাদের সুন্দর জীবনের কথা। তার সঙ্গে তাদের অসুবিধে আর প্রয়োজনের কথা। তখন কর্মকর্তারা ভাবতে বসল তাদের জীবনের সর্বাঙ্গিক উন্নতির কথা এবং তা সম্পন্ন করার পথ।সেখানে নতুন গ্রহে তাদের সুন্দর পরিবেশ, পরিষ্কার বায়ু, ভালো খাবার আর আনন্দের ভবিষ্যৎ জীবনকে আরও সুন্দর করার চেষ্টা চলতে লাগলো। কিন্তু পৃথিবীবাসীদের জীবন নরক হয়ে উঠল। মজার ব্যপার হল যারা এতদিন সব সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছিলেন পৃথিবীতে, আজ তারাই আর কিছু না ভেবে পালাতে চাইছিল এখান থেকে। প্রথমে বিভিন্ন দেশের মানুষ নিয়ম করে ওখানে গেলেও ক্রমশ তা মূল্যহীন হয়ে গেল। তখন দেশ, জায়গার সীমানা পেরিয়ে উপযুক্ত মানুষকে নিয়ে যাওয়াই প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠল। আর তখন সেই কিছু গুণাবলি থাকা মানুষই একমাত্র স্থান পেল মহাকাশযানে। যদিও পৃথিবীর শাসকরা ভিনগ্রহ থেকে তখনো পৃথিবীর উপর শাসন করছে, কিন্তু পৃথিবীবাসী সম্পূর্ণ লাগামহীন হয়ে পড়ল। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে আতঙ্কবাদীতে ছেয়ে গেল সবদিক। ছিনতাইবাজরা অক্সিজেন, খাদ্য বড়ি চুরি করতে লাগল সবদিকে। এভাবেই কিছু বছর কেটে গেল। সাধারণ মানুষ অবশেষে আসল পরিস্থিতি বুঝে পাগলের মতন নিজেদের কোনমতে মহাকাশে যাবার গুণাবলিতে মেলানোর চেষ্টা শুরু করল। সেই প্রচেষ্টায় স্বার্থপর, ভীতু, মরিয়া পৃথিবীবাসীর কাছে আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না এই জীবনে। তাদের ‘আই’ তে তাদের ব্যপারে সমস্ত কিছু নথিভুক্ত ছিল। সেখানে তাদের শিক্ষা, তাদের জন্ম, তাদের আচরণ, তাদের অসুখ এমনকি তাদের জিনের প্রকারও রাখা থাকত। বিয়ের প্রয়োজন আর তেমন ছিল না। থাকলেও দুজন মানুষ তাদের ‘আই’ তে তাদের জিনের প্রকার মিলিয়ে তবেই এগোতো। তারপর হঠাৎ একদিন এলো সর্বশেষ ধাক্কা। মহাকাশবাসিরা খবর পাঠাল আর কিছুজনের পর তারা মহাকাশযান পৃথিবীতে পাঠানো বন্ধ করে দেবে।সেখানে সুস্থ, সুন্দর পরিবেশ রাখতে বেশি মানুষের আর প্রয়োজন নেই। সাধারণ মানুষ এতদিন দুঃখে ছিল। কিন্তু এবার তাদের কাছে পুরো ব্যপারটা খুলে যেতে তারা পাগল হয়ে গেল। এবার তারা উপলব্ধি করল তারা এই মৃতপ্রায় পৃথিবীতে ধীরে ধীরে মরার জন্য রয়ে যাচ্ছে এবং কেউ তাদের জন্য কিছু করতে আর আগ্রহী নয়। খাঁচার বাঘের মতন তারা পালাবার পথ খুঁজতে লাগলো। কিন্তু মহাকাশযানে ওঠা তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব ব্যপার। চারিদিকে নিশ্ছিদ্র প্রহরা । যদিও বা কেউ সেই দুর্গ ভেদ করে এগোয়, সে আটকে যাবে তার শুচীকরণ, টিকাকরণ, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, বিশুদ্ধিকরণ ইত্যাদির লম্বা পদ্ধতিতে। সেখানে শরীরের সামান্য এদিকওদিক হলেই বাতিল। তাই সেই পরিস্থিতিতে অর্ক জানত সেও ধীরে ধীরে মরতে চলেছে এই পৃথিবীতেই। কিন্তু সেই সবুজ সঙ্কেত তার মনে প্রথম আশা জাগালো।
পৃথিবী থেকে মহাকাশে যাবার শেষ মহাকাশযান, যা ২৯ শে এপ্রিল ছাড়বে, সেখানে তার নাম যাত্রীদের মধ্যে আছে- এই খবর তার ‘আই’ তাকে জানায় সবুজ সঙ্কেত দিয়ে । হতভম্ব অর্ককে জানানো হয়েছিল যে সে নির্বাচিত হয়েছে তার শিক্ষা, তার অর্থ বা তার কাজের জন্য নয়। শুধুমাত্র তার জিনের আকার ভবিষ্যতের মহাকাশবাসীদের জন্য উপযুক্ত কিছু আদর্শ শিশু গড়ার জন্য সবচেয়ে ভালো তাই জন্য । সেই ভয়ানক দুঃসময়েও সে একা ঘরে হোহো করে হেসে ওঠে। সে, যে কিনা বিয়ে করেনি কারণ তার ছোট শিশু খুব একটা ভালো লাগেনা, সে একজন ‘স্পারম ডোনার’ হিসেবে স্থান পাবে সেখানে । কিন্তু বাস্তবে যে কারনেই হোক সে আর একবার বাঁচার সুযোগ পেয়ে, আপ্রাণ চেষ্টা করে সেটার সদ্ব্যবহার করতে । নিয়ম সে জানে। পার্থিব সবকিছু তাকে ছেড়ে যেতে হবে। তার টাকা, বই, জিনিস, পোশাক সমস্ত পড়ে থাকবে এখানে। নতুন পোশাক দেয়া হবে তাকে সম্পূর্ণ বিশুদ্ধিকরণের পর।
আসলে এই সব নিয়মাবলী সমস্ত সব পৃথিবীবাসীর কণ্ঠস্থ। কিন্তু তার চিন্তা অন্য কিছু নিয়ে। ‘আই’ এর সেই মেসেজের একদম শেষে একটি ছোট্ট নির্দেশিকা ছিল। সে পৃথিবী থেকে তার সঙ্গে শুধু তিনটি জিনিস নিয়ে যেতে পারবে। শুধু সেগুলো কোন জীবন্ত কিছু হবে না আর সেগুলোকে ঐ বিশুদ্ধকরণের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে।
পৃথিবীতে তার শেষ দিনে সে ভেবে পায় না সঙ্গে করে কি নিয়ে যাবে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে। অভ্যাস মতন প্রথমেই সে ভাবে তার শিক্ষাগত যোগ্যতার শংসাপত্রগুলোর কথা। কিন্তু পরক্ষণেই সে বোঝে কি মূল্যহীন হবে সেগুলো মহাকাশে। সেখানে সে চাকরি করতে যাচ্ছে না । তারপর সে ভাবে পুরনো কিছু ফটোর কথা, কিন্তু সেগুলি সবই তার ‘আই’ তে ঢোকান আছে। গত ৪৮ ঘণ্টা সে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ভেবে গেছে তার নিজের তিনটি অমুল্যনিধি কি হতে পারে তাই নিয়ে, কিন্তু কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি। টাকা নিয়ে যাওয়া অর্থহীন । কারণ তাকে কিছু কিনতে হবে না। সেখানে সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিস তাকে সরবরাহ করা হবে। একজন মানুষের কাছে অমুল্যনিধি কি হতে পারে? এর আগে সে বহুবার এই রকম পরিস্থিতির কথা ভেবেছে। কিন্তু তা সবই ভূমিকম্প, বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ের কথা সে ভেবেছে, যা আজকের এই পরিস্থিতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সে হঠাৎ অনুভব করে পার্থিব কোন কিছুরই মূল্য নেই বাইরে। তার ইতিহাস প্রিয় মন চায় নিতে তার অতি প্রিয় ইতিহাস বই কিছু, কিন্তু সেই সব তথ্য ‘আই’ এই আছে। তার ছোটবেলার কিছু জিনিস? তার বাবা মার কিছু স্মৃতিচিহ্ন? ব্রুনো ? ওহো, জীবিত কিছু তো নিয়ে যাওয়া নিষেধ।
পৃথিবীতে শেষ কয়েক ঘণ্টার এই প্রতীক্ষায় ও প্রত্যাশায় এমনিই তার মাথা ঝিমঝিম করছে, তারমধ্যে প্রিয় জিনিস খুঁজতে তার পাগল পাগল লাগে। জীবনে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান এর চিন্তা ছাড়া আর কি প্রয়োজনীয় হতে পারে?
শেষে সে ঠিক করে তার নিজস্ব ডাইরিটা নিয়ে যাবে সে । কোন নির্দিষ্ট দিন, সময়ের বিবরণ ইতিহাস বই এর মতন তাতে লেখা নেই, এ তার নিজস্ব জীবনের ইতিহাস, তার মনের কথ। সে জানে ওখানে এর মূল্য আর কারুর কাছে নেই । এমনকি তার মৃত্যুর পর এটা সোজা চলে যাবে রিসাইকলড হতে। কিন্তু তার কাছে এখনও এর মূল্য আছে । যেহেতু সে ওখানে ‘স্পারম ডোনার’ হিসেবে যাচ্ছে তাই কোনদিন হয়ত সে তার জৈবিক শিশুর দেখা পাবে, আর নাহলে যে কোন শিশুকে সেখানে দেখাবে পৃথিবীতে জীবন কি রকম ছিল, তার জীবন কি রকম ছিল এখানে । আর দেখাবে সাদা, মসৃণ, নরম এই জিনিসগুলোকে ‘কাগজ’ বলে। পৃথিবীতে কাগজ বানানো বহুদিন বন্ধ, তাই ওখানে কাগজ থাকার প্রশ্নই ওঠে না।
দ্বিতীয় জিনিস সে নেবে একটা টাকা। সে জানে ওখানে এটাও মূল্যহীন। কিন্তু পৃথিবীর মাটিতে সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস একটি স্মৃতিচিহ্ন হতেই পারে।
পাগলের মতন সে ভাবতে থাকে কি তার তৃতীয় জিনিস হবে। সে যখন তিনটি জিনিসের সুযোগ পেয়েছে তখন সে দুটি জিনিস নিয়ে যেতে চায় না। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে ঘুরতে থাকে। অবসন্ন শরীরে ও মনে সে ভাবতেই থাকে তার প্রিয় জিনিসগুলির কথা। ক্লান্ত শরীরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে তার মন ভাবাতেই থাকে তাকে । তার চোখ বন্ধ হয়ে আসে, কিন্তু সে আপ্রাণ চেষ্টা করে জেগে থাকার কারণ তার সময় ক্রমশ কমে আসছে।
************************************************
খুব কষ্ট করে ধীরে ধীরে চোখ খুলে ফেলে অর্ক। পারিপার্শ্বিক সবকিছুতে অভ্যস্ত হতে তার একটু সময় লাগে। প্রথমেই তার নজর যায় ক্যলেনডারের দিকে। সালটা ২০৪০ নয়, ২০২৫। তার প্রতিবেশীর টিভিটা জোরে শোনাচ্ছে কোথায় যেন দূষণ অত্যাধিক বেড়ে যাওয়ায় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
কুড়ি বছরের অর্ক চুপ করে বসে থাকে বিছানায় কিছুক্ষণ । তারপর পাশের ড্রয়ার থেকে তার ডাইরিটা বের করে তার বুকে চেপে ধরে সেটাকে। আজ সম্পূর্ণ অন্য দৃষ্টিতে সেটাকে দেখে সে, তার ভবিষ্যতের সঙ্গী, তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু এই পৃথিবীতে। সে তার পার্স থেকে একটা টাকা নিয়ে ডাইরির ভেতরে রাখে। কিন্তু অনেক চিন্তা করেও সে কিছুতেই তার তৃতীয় জিনিসটা মনে করতে পারে না। সে কি ভেবেছিল শেষে যে সে কি সঙ্গে নেবে? সময় বড় কম তার হাতে। মনের অলিতে গলিতে সে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে তার অন্যতম প্রিয় জিনিসকে ।
বাইরের দরজাটা একঘেয়ে শব্দে জোরে জোরে ধাক্কা খেয়েই চলেছে- ঠিক করে বোধহয় বন্ধ করা হয়নি। বেখেয়ালেই ঘুম থেকে উঠে অর্ক সেটা বন্ধ করতে যায়, কিন্তু তৎক্ষণাৎ তার মনে পড়ে আর দরকার নেই । এখানে আর মাত্র এক ঘণ্টা সময় বাকি আছে। যে সমস্ত জিনিসগুলো এতদিন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হত আজ তাদেরকে অবহেলায় উপেক্ষা করা যেতে পারে।
সচেতন হয়েই সে আর দেরি না করে পাগলের মত এ ঘর ও ঘর ছুটে বেড়াতে থাকে, নেড়েচেড়ে এটা ছুঁয়ে, ওটা ছুঁয়ে, কেটে যায় আরও দশ মিনিট। শেষে পরাস্ত সৈনিকের মত সে বসে পড়ে মেঝেতে আর প্রায় এক যুগ বাদে হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করে।
বেশ কিছু মাস ধরেই ঘোষণা চলছে খুব জোরে। বিশ্ব প্রযুক্তিগত প্রতিষ্ঠান, বিশ্ব মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র, বিশ্ব পরিবেশ সচেতক সংস্থা- সবাই মিলে কিছু ভাগ্যবান মানুষের নাম, দিন, তারিখ ঘোষণা করে চলেছে বারবার । অবিশ্বাস্যভাবে অর্ক সেনের নামও তার মধ্যে আছে। হাতে তার আর মাত্র একটি কাজই বাকি, বাকি সব হয়ে গেছে।
ভগবানকে আর একবার ধন্যবাদ জানায় সে তার দায়বদ্ধতাহীন এই অবিবাহিত অবস্থার জন্য। সত্যি কথা বলতে কি, খুব প্রয়োজন বোধও করেনি কখনো সে বিয়ে করার জন্য। তার বাবা মাও তার মতকে স্বাগত জানিয়েছেন সবসময়। যদিও সে কখনই ব্রম্ভচর্যে বিশ্বাস করেনি। অসংখ্য প্রেম এবং অসংখ্য সম্পর্ক যার প্রমাণ দেবে। কারণ যৌন সম্পর্কের জন্য ছাড়পত্রের প্রয়োজন পড়ে না। আর সন্তান সে কোনদিনই চায় নি।তার যুক্তি ছিল পৃথিবীতে ইতিমধ্যেই অনেক মানুষ আছে, আর না বাড়ালেও চলবে।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক অর্ক পাড়ার ব্যঙ্কের সামনে লাইনের শেষে গিয়ে দাঁড়ায়। আজকাল ব্যঙ্কের ভূমিকা এতো পালটে গেছে যে ভাবাই যায় না যে এখান থেকে আগে লোকে টাকা তুলত। কারণ এখন টাকা দিয়ে সেখান থেকেই জিনিস কেনা যায়। ‘টাকা’ কি অদ্ভুত এক জিনিস। এক অজানা অনুভুতি বয়ে যায় তার শরীর দিয়ে। আর কিছুক্ষণ পরে তার আর প্রয়োজন থাকবে না এই টাকার। কিন্তু এই পুরনো পৃথিবীতে এখনও তার ভীষণ প্রয়োজন। শুধু বড়লোকের হাতে বেশি টাকা, গরিবের হাতে কম টাকা আছে ।
তার নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়, যখন সব কিছু স্বাভাবিক ছিল। যদিও বয়স বেড়ে বেড়ে একদিন মরে যাওয়াকে যদি স্বাভাবিক বলে ধরা হয় । এইভাবেই চলছিল ২০৩০ অবধি। তার আগে ২০২০ এর মহামারি বাদ দিলে মোটামুটি সবাই মাস্ক ছাড়া হাঁটতে পারত, দোকান বাজার খোলা থাকতো, দেশ ভ্রমণের আনন্দ ছিল। পৃথিবীটা অনেক দেশে বিভক্ত ছিল। তারপর ধীরে ধীরে সব হাতের বাইরে চলে গেল। প্রশাসনব্যবস্থা ভয় পেতে শুরু করল, বিজ্ঞানীরা পাগল হয়ে গেল, আর সাধারণ মানুষ হয়ে গেল মূল্যহীন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ এক রোজকার ঘটনা হয়ে গেল। আর তার থেকেও দ্রুত পালটাতে লাগল মানুষের মন। ছোটো দুর্ঘটনা, কারুর মৃত্যু তাদেরকে আর তেমনভাবে নাড়া দিত না। জনসংখ্যা এমন ভয়াবহ বৃদ্ধি পেল যে একমাত্র কোন অলৌকিক ঘটনাই তাকে কমাতে পারত । তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ল দূষণ। কবে থেকে যেন মাস্ক পড়া ছাড়া আর উপায় রইলো না। জীবন পুরো পালটে গেল জলের অভাবে। স্নানের সংজ্ঞা উঠে গেল, রান্নার আর দরকার ছিল না স্বাস্থ্য বড়ির আগমনে । কিন্তু সে ছিল অন্য এক সময়ের সূচনা মাত্র। সব ওলটপালট হয় আরও অনেক পরে । কারণ তখনো সাধারণ মানুষ তাদের পুরনো অভ্যাস ছাড়তে পারেনি। নতুন নিয়ম বাইরে মানলেও, দরজা জানলা বন্ধ করে, চার দেওয়ালের মধ্যে, তারা আবার ফিরে যেত তাদের অস্বাভাবিক, কিন্তু স্বাভাবিক জীবনের ছন্দে।
অর্কর সব মনে আছে।ছোটো ছোটো সব পুরনো গল্প তার মনে আছে। ছোটো থেকেই তার বাবা মার কাছে পুরনো গল্প শুনতে খুব ভালো লাগতো তার । এখন তার মনে হয় তার ইতিহাস প্রীতি বোধহয় সেখান থেকেই শুরু।পুরানো সমাজ, পুরানো জীবন, পুরানো পৃথিবী- তাকে খুব টানে। কিন্তু আজ এই ২০৪০ এ এসে সেই ছোটবেলা, সেই স্কুল, সেই ইতিহাস পড়া এবং পড়ানো, সব কত দূরে মনে হয়। আজ মাত্র ৩৫ বছর বয়েসে সে একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। এমন নয় যে সে পড়াতে আর আগ্রহী নয় বা পড়ানোর আর কোন বিষয়বস্তু নেই। আসলে ‘ইতিহাস’ এই বিষয়টি পড়ানোর আর প্রয়োজন নেই। সারা পৃথিবীর ইতিহাস আজ প্রতিটি ছাত্র, প্রতিটি মানুষের নিজস্ব ইলেক্ট্রনিক ইউনিট বা ‘আই’ এ ঢোকান আছে। তার জন্য শিক্ষকের আর দরকার নেই। তার বাবা মা আমৃত্যু চিন্তিত ছিলেন তার ভবিষ্যৎ নিয়ে, তার ইতিহাস কে বিষয় হিসেবে বেছে নেয়া নিয়ে । কিন্তু তারা জানতেন না ভাগ্য তার জন্য অন্য গল্প লিখছে।
কাউনটারে ‘বিপ’ শব্দ শুনে আবার চমকে বর্তমানে ফিরে আসে অর্ক। ট্রেতে টাকা দিয়ে সে একদিনের মত খাদ্য বড়ি আর দুই বোতল অক্সিজেন নিয়ে নেয়। একবার ভাবে পাঁচ বোতল নেবে কিনা। কিন্তু তারপরেই তার মনে পড়ে কালকে থেকে এগুলো আবর্জনা হয়ে যাবে। ফেরার পথে তার চিত্রার সঙ্গে দেখা হয়। চিত্রার সঙ্গে সে অনেকদিন আগে এক সুন্দর সময় কাটিয়েছিল। যে কলেজে সে ইতিহাস পড়াতো সেখানেই চিত্রা সঙ্গীত শিক্ষিকা ছিল। বস্তুত চিত্রাই তার জীবনের প্রথম প্রেম। যদিও সে অনেকদিন আগের কথা। সে সম্পর্ক ভেঙ্গেছে বছর কয়েক পরেই, যদিও দুজনের সম্পর্ক তারপরেও বন্ধুত্বের। আজ কিন্তু চিত্রা তাকে দেখে তাড়াতাড়ি পাশ কাটিয়ে চলে গেল। অর্ক তাতেই কৃতজ্ঞ বোধ করে। অন্তত চিত্রা আর সবার মত ঝাঁপিয়ে পড়েনি তার উপর। নিজেকে হঠাৎ বিশ্বাসঘাতক বলে মনে হয় তার এই সমাজ, তার পরিচিত জন, এমনকি পুরো মানবজাতির প্রতি।ছুটে বাড়ি ফিরে দরজা বন্ধ করে সে।
মাত্র এক বছর আগে আচমকাই একদিন তার মাথায় বাজ পড়ে যখন সে তার চাকরির টারমিনেসন এর চিঠিটা পায় ‘আই’ তে। চুপ করে বসে থাকে অনেকক্ষণ। কিছুদিন থেকেই তার মনে হচ্ছিল এটা আসতে চলেছে।তবু হাতে পেয়ে তার মনে হয় সে এটার জন্য প্রস্তুত নয়। সবার প্রথমে যেটা নিয়ে ভয় হয় সেটা হল টাকা। এই অবস্থায় সে টাকা ছাড়া চালাবে কি করে। যেখানে বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন কিনতে হয় টাকা দিয়ে সেখানে সে কদিন চালাতে পারবে?আর খাবার জলের প্যকেটও প্রায় শেষ বাড়িতে, যা নাকি খাদ্য বড়ির থেকেও দুর্মূল্য। তার সঞ্চয় দিয়ে সে হয়ত আর এক মাস কোনমতে বেঁচে থাকতে পারবে, কিন্তু তারপর? শুধু এগুলো সব ঠিক হয়ে যেতে পারে, যদি সে কোন রকমভাবে একবার এই পৃথিবীর বাইরে যেতে পারে। কিন্তু সে সম্ভাবনা নেই। পৃথিবীর বাইরে যেতে পারে শুধু বিজ্ঞানীরা, বড় ব্যবসায়ীরা বা বিখ্যাত লোকেরা। তার মত সাধারণ মানুষের কোন সম্ভাবনাই নেই যাবার।সাধারণ জীবন, সাধারণ পটভূমির, সাধারণ জায়গার এক সাধারণ মানুষ।এখন আর পৃথিবী দেশে বিভক্ত নয়। সব মানুষের পরিচয় তার ‘আই’ তে আবদ্ধ একটি সংখ্যার দ্বারা। পৃথিবীতে আর কিছু বিনামূল্যে পাওয়া যায় না। জীবনের অত্যাবশ্যক জিনিস কিনতে হয় টাকা দিয়ে। তবে সাধারণ মানুষের পক্ষে তাও ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে অগুনতি জীবিকা বিলুপ্ত হয়ে যাবার জন্য।
আসলে সেই সব সাধারণ মানুষ শুধুমাত্র অর্থহীন হয়নি, তারা হয়ে উঠেছে মনুষ্যত্বহীনও। মানুষে মানুষে হিংসা, হানাহানি, স্বার্থপরতা সীমা ছাড়িয়ে গেছে। কোন সম্পর্কই জোরালো নয়। বিভ্রান্ত মানুষ শুধু একটা দিন আর বেঁচে থাকার জন্য লড়াই চালাচ্ছে রোজ নিজের রক্তের সম্পর্কের সঙ্গেও। পৃথিবীর মাটিতে এক অদ্ভুত জীব সৃষ্টি হয়েছে যেন।সেও সেই দলের একজন হয়ে যাবে ভেবে অর্কর ভয়ে বুক কেঁপে উঠল। তাও ভালো, বাড়িতে তার মুখ চেয়ে কেউ বসে নেই। তার কাছের বলতে আছে তার পুরনো কুকুর ব্রুনো ।কিন্তু সেও ফুসফুসের সঙ্ক্রমণে মৃত্যুপথযাত্রী। বিষাক্ত বায়ু তাকে বেশিদিন আর টানতে হবে না। কিন্তু তার নিজের দিন চলবে কি করে। যে প্রতিবেশীরা আজ তার সঙ্গে কথা বলছে, তার বেকারত্বর কথা শুনলে আর এমুখো হবে না। কারণ এখন সবাই জানে খাদ্য, জল ছাড়া এক সাধারণ, নিরীহ মানুষও কি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে।সে তার ‘আই’ খুলে দ্যাখে আর কত টাকা আছে তার। তারপর বৃদ্ধদের মতন ধীর পায়ে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। বহুক্ষণ পর্যন্ত তার ঘুম আসে না।
তবু পরের দিন সকালে সে দৃঢ় সঙ্কল্প হয়ে তার কলেজে আর একবার যায়। সেখানে তার সব সনাক্তকরণ এবং বিশুদ্ধিকরণ হয়ে গেলে, তাদের কনফারেন্স রুমের বড় মনিটরে সে তার ‘আই’ সংখ্যা দিয়ে ঢুকে তার বক্তব্য পেশ করে। কিন্তু কিছু লাভ হয়না । সে বোঝে যন্ত্রের যুক্তি একজন মানুষের থেকে অনেক ভালো। হতভাগ্য ‘পৃথিবীবাসী’দের (হ্যাঁ, এই নামেই ডাকা হয় সেই মানুষদের যাদের এখান থেকে আর কোথাও যাবার নেই) দলে আর একজন মরিয়া মানুষ বাড়লে কারুর কিছু এসে যায় না।
তার পরের দিনগুলো ঝাপসা অর্কর কাছে। কখন একটা দিন শুরু হয়েছে, আর কখন শেষ হয়েছে তা তার মনে নেই। তার ‘আই’ একেবারে চুপ হয়ে গিয়েছিলো। কারুর তাকে নিয়ে ভাবনা ছিল না। হাজারে হাজারে ‘পৃথিবীবাসী’দের মতন সেও একটা বোঝা হয়ে গিয়েছিল সবার কাছে। যার সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করতে চায় নি।বাড়ির চেনা পরিবেশ, চেনা বিছানা, চেনা বই, চেনা ফটো কিছুতেই যেন তার মনের ভার কমছিল না। তার নিষ্ক্রিয় ‘আই’ কে পাশে রেখে সারাদিন সেও একই রকম ভাবে বিছানায় শুয়ে কাটিয়ে দিত । এইভাবেই হঠাৎ একদিন একটা সবুজ আলো জ্বলে উঠল তার ‘আই’ তে। আর এক যান্ত্রিক স্বর তার সঙ্গে কথা বলল।
************************************************
নির্বাচিত যে মানুষরা প্রথম মহাকাশযানে ওঠার অনুমতি পেয়েছিল তারা সবাই নয় বিজ্ঞানী আর নয়ত বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বরা । কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই নাটকীয়ভাবে সব কিছু ওলটপালট হয়ে গেলো। যাবার জন্য নিয়ম পালটাতে লাগল প্রতিদিন।যারা পৃথিবীর বাইরে জায়গা পেল তারা পৃথিবীবাসীদের জানাতে লাগল তাদের সুন্দর জীবনের কথা। তার সঙ্গে তাদের অসুবিধে আর প্রয়োজনের কথা। তখন কর্মকর্তারা ভাবতে বসল তাদের জীবনের সর্বাঙ্গিক উন্নতির কথা এবং তা সম্পন্ন করার পথ।সেখানে নতুন গ্রহে তাদের সুন্দর পরিবেশ, পরিষ্কার বায়ু, ভালো খাবার আর আনন্দের ভবিষ্যৎ জীবনকে আরও সুন্দর করার চেষ্টা চলতে লাগলো। কিন্তু পৃথিবীবাসীদের জীবন নরক হয়ে উঠল। মজার ব্যপার হল যারা এতদিন সব সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছিলেন পৃথিবীতে, আজ তারাই আর কিছু না ভেবে পালাতে চাইছিল এখান থেকে। প্রথমে বিভিন্ন দেশের মানুষ নিয়ম করে ওখানে গেলেও ক্রমশ তা মূল্যহীন হয়ে গেল। তখন দেশ, জায়গার সীমানা পেরিয়ে উপযুক্ত মানুষকে নিয়ে যাওয়াই প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠল। আর তখন সেই কিছু গুণাবলি থাকা মানুষই একমাত্র স্থান পেল মহাকাশযানে। যদিও পৃথিবীর শাসকরা ভিনগ্রহ থেকে তখনো পৃথিবীর উপর শাসন করছে, কিন্তু পৃথিবীবাসী সম্পূর্ণ লাগামহীন হয়ে পড়ল। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে আতঙ্কবাদীতে ছেয়ে গেল সবদিক। ছিনতাইবাজরা অক্সিজেন, খাদ্য বড়ি চুরি করতে লাগল সবদিকে। এভাবেই কিছু বছর কেটে গেল। সাধারণ মানুষ অবশেষে আসল পরিস্থিতি বুঝে পাগলের মতন নিজেদের কোনমতে মহাকাশে যাবার গুণাবলিতে মেলানোর চেষ্টা শুরু করল। সেই প্রচেষ্টায় স্বার্থপর, ভীতু, মরিয়া পৃথিবীবাসীর কাছে আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না এই জীবনে। তাদের ‘আই’ তে তাদের ব্যপারে সমস্ত কিছু নথিভুক্ত ছিল। সেখানে তাদের শিক্ষা, তাদের জন্ম, তাদের আচরণ, তাদের অসুখ এমনকি তাদের জিনের প্রকারও রাখা থাকত। বিয়ের প্রয়োজন আর তেমন ছিল না। থাকলেও দুজন মানুষ তাদের ‘আই’ তে তাদের জিনের প্রকার মিলিয়ে তবেই এগোতো। তারপর হঠাৎ একদিন এলো সর্বশেষ ধাক্কা। মহাকাশবাসিরা খবর পাঠাল আর কিছুজনের পর তারা মহাকাশযান পৃথিবীতে পাঠানো বন্ধ করে দেবে।সেখানে সুস্থ, সুন্দর পরিবেশ রাখতে বেশি মানুষের আর প্রয়োজন নেই। সাধারণ মানুষ এতদিন দুঃখে ছিল। কিন্তু এবার তাদের কাছে পুরো ব্যপারটা খুলে যেতে তারা পাগল হয়ে গেল। এবার তারা উপলব্ধি করল তারা এই মৃতপ্রায় পৃথিবীতে ধীরে ধীরে মরার জন্য রয়ে যাচ্ছে এবং কেউ তাদের জন্য কিছু করতে আর আগ্রহী নয়। খাঁচার বাঘের মতন তারা পালাবার পথ খুঁজতে লাগলো। কিন্তু মহাকাশযানে ওঠা তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব ব্যপার। চারিদিকে নিশ্ছিদ্র প্রহরা । যদিও বা কেউ সেই দুর্গ ভেদ করে এগোয়, সে আটকে যাবে তার শুচীকরণ, টিকাকরণ, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, বিশুদ্ধিকরণ ইত্যাদির লম্বা পদ্ধতিতে। সেখানে শরীরের সামান্য এদিকওদিক হলেই বাতিল। তাই সেই পরিস্থিতিতে অর্ক জানত সেও ধীরে ধীরে মরতে চলেছে এই পৃথিবীতেই। কিন্তু সেই সবুজ সঙ্কেত তার মনে প্রথম আশা জাগালো।
পৃথিবী থেকে মহাকাশে যাবার শেষ মহাকাশযান, যা ২৯ শে এপ্রিল ছাড়বে, সেখানে তার নাম যাত্রীদের মধ্যে আছে- এই খবর তার ‘আই’ তাকে জানায় সবুজ সঙ্কেত দিয়ে । হতভম্ব অর্ককে জানানো হয়েছিল যে সে নির্বাচিত হয়েছে তার শিক্ষা, তার অর্থ বা তার কাজের জন্য নয়। শুধুমাত্র তার জিনের আকার ভবিষ্যতের মহাকাশবাসীদের জন্য উপযুক্ত কিছু আদর্শ শিশু গড়ার জন্য সবচেয়ে ভালো তাই জন্য । সেই ভয়ানক দুঃসময়েও সে একা ঘরে হোহো করে হেসে ওঠে। সে, যে কিনা বিয়ে করেনি কারণ তার ছোট শিশু খুব একটা ভালো লাগেনা, সে একজন ‘স্পারম ডোনার’ হিসেবে স্থান পাবে সেখানে । কিন্তু বাস্তবে যে কারনেই হোক সে আর একবার বাঁচার সুযোগ পেয়ে, আপ্রাণ চেষ্টা করে সেটার সদ্ব্যবহার করতে । নিয়ম সে জানে। পার্থিব সবকিছু তাকে ছেড়ে যেতে হবে। তার টাকা, বই, জিনিস, পোশাক সমস্ত পড়ে থাকবে এখানে। নতুন পোশাক দেয়া হবে তাকে সম্পূর্ণ বিশুদ্ধিকরণের পর।
আসলে এই সব নিয়মাবলী সমস্ত সব পৃথিবীবাসীর কণ্ঠস্থ। কিন্তু তার চিন্তা অন্য কিছু নিয়ে। ‘আই’ এর সেই মেসেজের একদম শেষে একটি ছোট্ট নির্দেশিকা ছিল। সে পৃথিবী থেকে তার সঙ্গে শুধু তিনটি জিনিস নিয়ে যেতে পারবে। শুধু সেগুলো কোন জীবন্ত কিছু হবে না আর সেগুলোকে ঐ বিশুদ্ধকরণের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে।
পৃথিবীতে তার শেষ দিনে সে ভেবে পায় না সঙ্গে করে কি নিয়ে যাবে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে। অভ্যাস মতন প্রথমেই সে ভাবে তার শিক্ষাগত যোগ্যতার শংসাপত্রগুলোর কথা। কিন্তু পরক্ষণেই সে বোঝে কি মূল্যহীন হবে সেগুলো মহাকাশে। সেখানে সে চাকরি করতে যাচ্ছে না । তারপর সে ভাবে পুরনো কিছু ফটোর কথা, কিন্তু সেগুলি সবই তার ‘আই’ তে ঢোকান আছে। গত ৪৮ ঘণ্টা সে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ভেবে গেছে তার নিজের তিনটি অমুল্যনিধি কি হতে পারে তাই নিয়ে, কিন্তু কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি। টাকা নিয়ে যাওয়া অর্থহীন । কারণ তাকে কিছু কিনতে হবে না। সেখানে সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিস তাকে সরবরাহ করা হবে। একজন মানুষের কাছে অমুল্যনিধি কি হতে পারে? এর আগে সে বহুবার এই রকম পরিস্থিতির কথা ভেবেছে। কিন্তু তা সবই ভূমিকম্প, বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ের কথা সে ভেবেছে, যা আজকের এই পরিস্থিতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সে হঠাৎ অনুভব করে পার্থিব কোন কিছুরই মূল্য নেই বাইরে। তার ইতিহাস প্রিয় মন চায় নিতে তার অতি প্রিয় ইতিহাস বই কিছু, কিন্তু সেই সব তথ্য ‘আই’ এই আছে। তার ছোটবেলার কিছু জিনিস? তার বাবা মার কিছু স্মৃতিচিহ্ন? ব্রুনো ? ওহো, জীবিত কিছু তো নিয়ে যাওয়া নিষেধ।
পৃথিবীতে শেষ কয়েক ঘণ্টার এই প্রতীক্ষায় ও প্রত্যাশায় এমনিই তার মাথা ঝিমঝিম করছে, তারমধ্যে প্রিয় জিনিস খুঁজতে তার পাগল পাগল লাগে। জীবনে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান এর চিন্তা ছাড়া আর কি প্রয়োজনীয় হতে পারে?
শেষে সে ঠিক করে তার নিজস্ব ডাইরিটা নিয়ে যাবে সে । কোন নির্দিষ্ট দিন, সময়ের বিবরণ ইতিহাস বই এর মতন তাতে লেখা নেই, এ তার নিজস্ব জীবনের ইতিহাস, তার মনের কথ। সে জানে ওখানে এর মূল্য আর কারুর কাছে নেই । এমনকি তার মৃত্যুর পর এটা সোজা চলে যাবে রিসাইকলড হতে। কিন্তু তার কাছে এখনও এর মূল্য আছে । যেহেতু সে ওখানে ‘স্পারম ডোনার’ হিসেবে যাচ্ছে তাই কোনদিন হয়ত সে তার জৈবিক শিশুর দেখা পাবে, আর নাহলে যে কোন শিশুকে সেখানে দেখাবে পৃথিবীতে জীবন কি রকম ছিল, তার জীবন কি রকম ছিল এখানে । আর দেখাবে সাদা, মসৃণ, নরম এই জিনিসগুলোকে ‘কাগজ’ বলে। পৃথিবীতে কাগজ বানানো বহুদিন বন্ধ, তাই ওখানে কাগজ থাকার প্রশ্নই ওঠে না।
দ্বিতীয় জিনিস সে নেবে একটা টাকা। সে জানে ওখানে এটাও মূল্যহীন। কিন্তু পৃথিবীর মাটিতে সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস একটি স্মৃতিচিহ্ন হতেই পারে।
পাগলের মতন সে ভাবতে থাকে কি তার তৃতীয় জিনিস হবে। সে যখন তিনটি জিনিসের সুযোগ পেয়েছে তখন সে দুটি জিনিস নিয়ে যেতে চায় না। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে ঘুরতে থাকে। অবসন্ন শরীরে ও মনে সে ভাবতেই থাকে তার প্রিয় জিনিসগুলির কথা। ক্লান্ত শরীরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে তার মন ভাবাতেই থাকে তাকে । তার চোখ বন্ধ হয়ে আসে, কিন্তু সে আপ্রাণ চেষ্টা করে জেগে থাকার কারণ তার সময় ক্রমশ কমে আসছে।
************************************************
খুব কষ্ট করে ধীরে ধীরে চোখ খুলে ফেলে অর্ক। পারিপার্শ্বিক সবকিছুতে অভ্যস্ত হতে তার একটু সময় লাগে। প্রথমেই তার নজর যায় ক্যলেনডারের দিকে। সালটা ২০৪০ নয়, ২০২৫। তার প্রতিবেশীর টিভিটা জোরে শোনাচ্ছে কোথায় যেন দূষণ অত্যাধিক বেড়ে যাওয়ায় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
কুড়ি বছরের অর্ক চুপ করে বসে থাকে বিছানায় কিছুক্ষণ । তারপর পাশের ড্রয়ার থেকে তার ডাইরিটা বের করে তার বুকে চেপে ধরে সেটাকে। আজ সম্পূর্ণ অন্য দৃষ্টিতে সেটাকে দেখে সে, তার ভবিষ্যতের সঙ্গী, তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু এই পৃথিবীতে। সে তার পার্স থেকে একটা টাকা নিয়ে ডাইরির ভেতরে রাখে। কিন্তু অনেক চিন্তা করেও সে কিছুতেই তার তৃতীয় জিনিসটা মনে করতে পারে না। সে কি ভেবেছিল শেষে যে সে কি সঙ্গে নেবে? সময় বড় কম তার হাতে। মনের অলিতে গলিতে সে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে তার অন্যতম প্রিয় জিনিসকে ।
0 comments
Add your comment here
Use the following form to leave your comment on this prose
Statistics
Number of VISITORS | 28038 |
Number of REGISTERED USERS | 4956 |
Number of Writers | 2121 |
Total Number of Poems | 3 |
Total Number of Prose | 17 |
Search
Writers’ list
" সুদীপ্ত মণ্ডল (SUDIPTA MONDAL) "
স্বরূপ মুখার্জ্জী (Swarup Mukherjee)
Bhaswati Banerjee Roychowdhury
Dr. Pinki Purkayastha Chandrani
Dr. Satyadarshi Roy, A Homoeopathy Consultant
KOUSHIKA CHAKRABORTY MUKHERJEE
Paromita Raha Halder ( Bijoya)
Paromita Raha Halder ( Bijoya)
Prithwish Datta (পৃথ্বীশ দত্ত)
Romi Roy Chowdhury Chakraborty
SHARADINDU CHAKRABORTY শরদিন্দু চক্রবর্তী
Sonali Bhattacharyya Mukherjee
subarnarekha dhar (chatterjee)
Subhasree Bhattacharjee (শুভশ্রী ভট্টাচার্য্য)
SUMANTA BHOWMICK - সুমন্ত ভৌমিক
প্রসেনজীত কর মালাকার (রাতের আঁধার)
শাহীনূর মুস্তাফিজ(বিপ্লবী কবি)