Prose Details
মন্দোদরী এবং দশগ্রীবের শেষ রাত
১
অবশেষে ত্রিকূট পাহাড়ের চূড়ায় যে অন্তিম রশ্মি লেগেছিল , তাও একটু একটু করে অনেক আগেই নিভে গেছে । লঙ্কাপুরীর মশালে যে কটা ক্ষীণ আলো শেষ নিঃশ্বাসের মত বুকের জোর দেখাচ্ছিল , তাতেই উজ্জ্বল এক স্বর্ণ আলোর বিচ্ছুরণ জানিয়ে যাচ্ছে দশগ্রীব এখনো রাজসভায় রত্ন সিংহাসনে । তবে একা , সম্পূর্ণ বান্ধবহীন । মুখে বিষাদের মধ্যেও কোথাও যেন জয়লাভের আস্বাদন । এ অভিব্যাক্তি একান্তই যেন তার ।
আগেই বিদায় করেছেন চামরধারীদের । কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছে মহামহিম দশগ্রীব শান্ত হচ্ছেন । দৃঢ় প্রত্যয় তার প্রতি রন্ধ্রে জেগে উঠছে । অকস্মাৎ দুই হাতে তালি দিয়ে উঠলেন । রাতের নির্জনতায় সোনার লঙ্কায় প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠলো সে শব্দ ।
ত্রিকূট পাহাড়ে যে ময়ূর ময়ূরী রাতের ক্লান্তির ঘুম দিচ্ছিল , সন্তান হারা প্রজারা অগ্নিকুণ্ডের সামনে নীরবে চোখের জল ফেলছিল , অশোকবনে যে চেরিরা পাহারা দিয়ে চলেছে দেবী সীতাকে , যে নদী ছলছল কলকল রবে সোনার লঙ্কার যুদ্ধ ক্ষেত্রের পাশে নানা স্মৃতি বহন করতে করতে দেশ থেকে দেশান্তরে অথবা ভারত মহাসাগরে গিয়ে মিশছে , ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে থাকলো ।
মহারাজার গম্ভীর আর্তরব শুনেছে আগেও তারা , যখন , দৈত্যরাজকন্যা পুষ্পৎকটার রূপে মুগ্ধ হয়ে মহর্ষি পুলস্তের পুত্র বিশ্রবাঃ তাকে দশদিন ধরে সম্ভোগ করেন এবং অবলা সেই পুষ্পৎকটা জন্ম দিয়েছিলেন রাবণকে । জন্মকালে তার অতিমানবীয় বাল্য কান্না সর্বলোকে কম্পন সৃষ্টি করেছিল না জানি কী হয় এই ভয়ে ।
আর আজ এই গভীর রাতে সেইরকম ধ্বনি । যদিও এই ধ্বনির মধ্যে প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত , রাজা এখন রাজনর্তকীর নৃত্য দেখতে চান ।
লঙ্কেশের সভায় এখন মৃদঙ্গ-রুদ্রবীণা ইত্যাদি বাদকদল নর্তকীর পায়ে ছন্দ তুলে চলেছে । কিন্তু মন সায় দিচ্ছে না । ক্ষণিক আনন্দ দশাননের হৃদয়ে তুলছে না দীর্ঘ শান্তি । অবশেষে তিনি নীরবে সবকিছু ফেলে ধীর এক অপরিচিত লয়ে চললেন রাজ অন্তপুরে । যেখানে তার প্রিয় পত্নী দেবী মন্দোদরী রয়েছেন । কী জানি অসুররাজ ময়াসুর ও অপ্সরা হেমার কন্যা মন্দোদরী আজও সকল অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে অপেক্ষা করে আছেন কিনা !
এই প্রথম রাবণের বুকের এক অজানা জগতে ভয় হতে শুরু করল । দুই হাত দিয়ে চন্ধন কপাট খুললেন । ঘরের অন্দরে উজ্জ্বল দীপ অনেকটাই নিষ্প্রভ । সহচরী আজ আর নেই এই ঘরেও । সামনেই পরে রয়েছে রত্ন খচিত পালঙ্ক । মহিষী কোথায় ! মন্দোদরী কী তবে আজ তাকে ফেলে রেখে চলে গেছেন পিত্রালয়ে !
রাবণ সেই বিশাল পালঙ্কের একপ্রান্তে বসে পরলেন । কয়েক সের ওজনের স্বর্ণ -রত্ন বেষ্টিত বিশাল রাজমুকুট রাখলেন খুলে । তিনি বিশ্রাম চান । আগামী প্রভাতেই তার হয়তো মুক্তি । দুচোখে তার শ্রান্তির ঘেরাটোপ ।
“ রাজন , তুমি ঘুমাতে চাও ? কেন এই ঘুম তোমার চোখে আজ ! “ মন্দোদরীর আবেগহীন দৃঢ় কণ্ঠস্বরে মুখ তুলে চাইলেন লঙ্কেশ । মনে হল এ যেন তার প্রিয়সখী প্রানাধিক প্রিয় পত্নী মন্দোদরীর কণ্ঠস্বর নয় । এ যেন হিমালয়ের বুকে জমাট তুষার ভাঙনের নিনাদ ।
“ মন্দোদরী , আমি ক্লান্ত । হে শিব-স্বয়ম্ভু একটু ঘুম দাও এই দুই চোখে । “ রাবণের কণ্ঠে প্রথমবার আর্তির সাক্ষী থেকে গেল কেবল অন্তপুরে দীপ্যমান অগ্নি বর্তিকারা-প্রায় নিষ্প্রভ অগ্নি শিখারা ।
“ কিন্তু রাজা , তুমি কেবল নিজেরটাই ভেবে গেলে ! আমার অন্যায় কোথায় ? না না আমি তোমাকে ঘুমাতে দিতে পারি না । “
“ তুমি কী চাও মন্দোদরী ! তুমি কী চাও পরাজিত হই ? তুমি কী চাও কালের পৃষ্ঠায় লেখা হয়ে থাকুক যুদ্ধের আগে লঙ্কা অধিপতি রাবণ কেবল একবার দুই চোখের পাতা এক করতে চেয়েছিল , কিন্তু পারে নি ...। বল বল ...বল মন্দোদরী... “ শেষের দিকে রাবণের কণ্ঠস্বরে মনে হল লেগেছে সমুদ্র বাষ্পের মত একরাশ লবণাক্ত অজানা অভিমান ।
“ চমৎকার রাজা চমৎকার ! ওঠো ,চল । চল সমুদ্রতটে । এই অন্তপুর এখন আমার কাছে কেবলমাত্র জতুগৃহ । এখানকার বাগিচার পুষ্প , যা প্রতিদিন আমার পায়ে নুপুরের মত বেষ্টন করে থাকে , তারা যেন আজ আমার এই দেহে নাগপাশ । সারা শরীরময় বিষের জ্বালা । তুমি ওঠো রাজা ।“ মন্দোদরীর এই নিষ্পাপ আবেদনে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারলেন না রাজা দশগ্রীব ।
২
সেইদিন যেদিন লঙ্কার আকাশে একটা কালো শকুন অনেকটা নীচ দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল , যেদিন তার দুই পাখায় উচ্চারিত হচ্ছিল , ‘ হায় ইন্দ্রজিৎ হায় ইন্দ্রজিৎ ‘।
যখন লঙ্কায় আর্য রাম সীতাকে উদ্ধারের জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিলেন , সেইদিনই মেঘনাদ সুলোচনার কথা উপেক্ষা করেছিলেন ।
স্বামীকে কাতর স্বরে সুলোচনা বলেছিলেন , “ তুমি তো বলশালী , তবে কেন নিকুম্ভিলা যজ্ঞের আয়োজন । মন বড়ই চঞ্চল হয়ে উঠেছে ।“
মেঘনাদ মৃদু হেসে বলেছিলেন , “ প্রিয়ে অনার্য যে কম নয় তার প্রমাণ রেখে যাবো ইতিহাসের গর্ভে ।“
রাজমাতা মন্দোদরী বুঝেছিলেন পুত্রবধু সুলোচনার হৃদয়ে কেন এই ঝড়ের সংকেত । তিনি পরম স্নেহে বুকের মধ্যে আশ্রয় দিয়েছিলেন আরেক অবলা নারীকে ।
রাবণ লঙ্কা ছেড়ে তিন যোগ্য পুত্রের হাতে দায়িত্ব অর্পণ করে ত্রিলোক জয়ে বেরিয়েছিলেন । আর ঠিক তখনই লঙ্কার এক মনোরম উপবন নিকুম্ভিলায় মেঘনাদ অগ্নিষ্টোম, অশ্বমেধ, বহুসুবর্ণক, রাজসূয়, গোমেধ, বৈষ্ণব ও মাহেশ্বর নামে সাতটি যজ্ঞ সম্পাদনা করেন। এই যজ্ঞসমূহের ফলে তিনি শিবের কাছ থেকে কামগ স্যন্দন, তামসী মায়া, অক্ষয় ইষুধি ও আরো অনেক অস্ত্রশস্ত্র লাভ করেন।
যজ্ঞের কোন ত্রুটি রাখেন নি । পরম অনুশীলনে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন দেবকুল । আশীর্বাদও করেছিলেন ।
অবশেষে এক সন্ধ্যায় দিগ্বিজয় করে আনন্দ উল্লাস আর জয়ধ্বনির মাঝে খুলে যায় লঙ্কার তোরণ । তুরী ভেরী নানা বাদ্যের মাঝে লঙ্কাধিপতি প্রবেশ করেন মহলে । মন্দোদরী প্রথা মেনে রাজটীকা পরিয়ে দেন । পরম যত্নে ক্ষতে প্রলেপ দিয়ে দেন ।
ইদ্রজিত পিতাকে প্রণাম করে সেদিন সন্ধ্যায় ভেবেছিলেন অনেক আশিস করবেন রাবণ । কিন্তু হায় ইদ্রজিত , সে জানতো না বৈষ্ণব যজ্ঞ করার জন্য রাবণ অতিশয় বিরক্ত হয়ে তীব্র ধিক্কার করবেন ।
মা আবার অন্যদিকে রানী মন্দোদরী সে রাতে তাদের মাঝে অন্তরাল না হলে রাবণের কোপে ইদ্রজিত হয়তো ...!
নাহ । সেদিন মন্দোদরীর সামনে কিছুই আর করেন নি তিনি বরং ইন্দ্রজিতের মাথা যে পুরোহিত খেয়েছিলেন সেই শুক্রাচার্যকে বারবার ধিক জানিয়েছিলেন ।
রাবণ হয়তো জানতেন ,তাই তিনি বলে উঠেছিলেন উপস্থিত আচার্যের দিকে তাকিয়ে , “ আর কতদিন অসুরকুলের সর্বনাশের জন্য ছল পৌরোহিত্য করবেন ? দেবতারা নানা অস্ত্র দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু আপনিই বলুন তো যে অস্ত্রে আজ ইন্দ্রজিৎ সাজিয়ে তুলেছে তার অস্ত্রভাণ্ডার সেই অস্ত্রের আড়ালেই দেবকুল ওর মৃত্যুবাণ লুকিয়ে রেখে গেল কিনা ?“
বিস্মিত মন্দোদরী স্বামীর এরূপ কথায় । হাহাকার করে ওঠে তার বুক ।
করুণ আর্তি মেশানো স্বরে তিনিও বললেন , “ এ কী করলেন আচার্য ! আপনি আমার কথা , এক মায়ের কথা ভাবলেন না ? সুলোচনার কাছে এর উত্তর আপনি দিতে পারবেন তো ?”
স্থির থাকতে পারলেন না এই যুগপৎ আক্রমনে ।
কুপিত যজ্ঞের হোতা শুক্রাচার্য মন্দোদরীর দিকে তাকিয়ে কটাক্ষ করে রাবণকে শাপ দিয়ে বললেন , “ রাবণ যখন এতোটাই জেনে গেছো তখন এটাও শুনে রাখো তুমি তোমার জামাতার হাতেই নিহত হবে ।“
জামাতার হাতে !! এ যে বড় লজ্জার । দুর্ভাগা মন্দোদরী ! কতবার আর কতকাল সকল কলঙ্ক নিজের অস্তিত্বে ধারণ করেছেন ।
৩
এখন সিংহল দ্বীপে আছড়ে পরছে ঢেউ । সামনেই দিগন্ত বিস্তৃত ভারত মহাসাগর । রাতের সমুদ্র পাখীরা কীসের সন্ধানে তীক্ষ্ণ রবে রাতের গভীরতা বাড়িয়ে তুলেছেন । ক্লান্ত রাবণ রত্ন শয্যায় শায়িত । মন্দোদরী ধীরে ধীরে উঠে এলেন মণিময় গবাক্ষের কাছে ।
বাইরে সামুদ্রিক হাওয়া রেশমের মত কোমল চুলে আলপনা কেটে দিয়ে যাচ্ছে ।
‘ কী পেলাম এ জীবনে ! পরম জ্ঞানী , তপস্বী , শৈব স্বামী সব কী দিতে পেরেছেন ? হ্যাঁ হয়তো পেরেছেন । ‘ কথাগুলো ভাবতে ভাবতে তিনি বেরিয়ে এলেন রাজ অন্তপুর থেকে অশোকবনে । এখানে আসতে কোনদিনই বাধা কেউই দেন নি , দশগ্রীবও না । বরং মাঝেমধ্যে তিনিই বলতেন , “ যাও মন্দোদরী মেয়েটির কাছে যাও , দেখে এসো কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা ।“
‘ তবে কী স্বামী জানতে পেরেছেন সেই গোপন কথাটি ? ‘ আবার ভাবেন , ‘ সে কী করে সম্ভব ! সেই রাতে দাসী আর সেই তো গেছিল বাধ্য হয়ে বসুন্ধরার কাছে ‘।
মন্দোদরীর কমলের মত দুই চোখে অশ্রু জমতে থাকে ।
সীতা তখনও ঘুমিয়ে পরেন নি । বরং নিজের মায়ের চোখে জল দেখে আঁচল দিয়েই মুছিয়ে দিলেন মন্দোদরীর সকল ব্যাথা ।
হয়তো এক নারী আরেক নারীর কথা সহজে বুঝতে পারেন । এই দীর্ঘকাল অশোকবনে থাকার সময়ে মন্দোদরী যেমন জানিয়েছিলেন যে তিনিই সীতার হত ভাগ্য মা তেমন এটাও বলতে ভোলেন নি রাবণের অপকর্মের কাহিনী ।
তিনি বলেছিলেন , “ সীতা জানি না আমি ভুল করেছিলাম কিনা ! জানি না দৈব শাপের হাত থেকে মুক্ত করাবার জন্য এ ঘটনা ঘটে চলেছে কিনা ! তাও , আমি কী করে ভুলি , যে আমি যে স্বামীকে পুজো করি , শ্রদ্ধা করি সেই দশাননই লোভের বশবর্তী হয়েছিলেন ।“ আজকের রাতের মত সেদিনও মাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিজের হৃদ স্পন্দনের সাথে মায়ের স্পন্দন অনুভব করেছিলেন সীতা প্রথমবার ।
সে রাতেও মন্দোদরী সজল চোখে বলেছিলেন , “ মা লক্ষ্মী , তুই তো সকলই জানিস তাও বলি , রাবণ ঋষিদের হত্যা করে তাঁদের রক্ত একটি বৃহৎ কলসে সঞ্চয় করে রেখেছিলেন। ঋষি গৃৎসমদ দেবী লক্ষ্মীকে কন্যারূপে পাওয়ার জন্য তপস্যা করছিলেন। তিনি দর্ভ ঘাস থেকে দুগ্ধ সংগ্রহ করে তা মন্ত্রপূত করে একটি পাত্রে সঞ্চয় করছিলেন যাতে লক্ষ্মী সেখানে অবতীর্ণ হতে পারেন। “
মন্দোদরী ক্ষণিক কাল মৌন হলেন । দেবী সীতা হতভাগ্য নারী-মা’কে আরো কাছে টেনে নিলেন । কিছুটা শান্ত হলেন তিনি ।
পুনরায় বলেন , “ একেই বলে ভাগ্য । রাবণ এই দুগ্ধ ঋষিরক্তের কলসে ঢেলে দেন। ঋষিরক্তকে প্রচার করা হয় সকল বিষের চেয়েও বিষাক্ত ।
সেদিনই আমিই আর বেঁচে থাকতে চাই নি । অপকর্মে মর্মাহত হয়ে তাই এই বিষাক্ত রক্ত পান করে আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম । কিন্তু রক্ত পান করার ফলে গৃৎসমদ সঞ্চিত দুগ্ধের প্রভাবে গর্ভবতী হয়ে পরি । লক্ষ্মীরূপে তুই আমার গর্ভে প্রবেশ করিস।“
এই দীর্ঘ কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেই মন্দোদরী চুপ করে গেলেন ।
সীতা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খুবই ধীরে বললেন , “ আমাকে ভ্রূণ অবস্থায় কুরুক্ষেত্রের মাটির তলায় প্রোথিত করে দিলে । রাজা জনক সীতা বলে লালন-পালন করলেন ।“
খানিক চুপ থেকে সীতা বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করলেন , “ মা নারীরাই কেন এত ত্যাগ করবেন ? তুমি কেন আমাকে সরিয়ে দিলে তোমার বুক থেকে ? একটুও কাঁপল না হৃদয় ?”
এই তীব্র আঘাত যে আসবে তা জানতেন মন্দোদরী । প্রস্তুত ছিলেন তিনি । আজই শেষ রাত তার জীবনের । যে কথাগুলো এতকাল কাওকে বলতে পারেন নি , আজ সে সময় , সেই ক্ষণ উপস্থিত ।
তিনি দু’হাত দিয়ে চোখের জল মুছে বললেন , “ হয়তো আমি-তুই নারী বলেই এত দহন । যতবার দগ্ধ হয়েছি ততবার কঠিন হয়েছে সংকল্প । সীতা তুই ,রাবণ ও তাঁর বংশের ধ্বংসের কারণ হবি বলে ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছিল । তাই তোর পিতা রাবণের আদেশেই পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলাম ।“
সীতা বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন , “ পিতা কী জানতো না যে আমি তার একমাত্র কন্যা !!”
মন্দোদরী নীরবে মাথা নাড়িয়ে না জানালেন ।
তিনি স্থীর ভাবে বললেন , “ নাহ ! তিনি কেবল জানতেন তুই জারজ আর তার বংশের মৃত্যুর কারণ হবি , তাই...। তবে পরে হয়তো অনুমান করেছিলেন । তাই তো তোকে জগত লক্ষ্মীকে নিয়ে আসে রামের সাথে ছলনা করে ...। তিনি এখন বৃদ্ধ । সেজন্যই হয়তো তোকে কাছ ছাড়া করতে চান না ।“
৪
আকাশের পূর্ব কোণ ক্রমে রক্তিম বর্ণ হয়ে উঠছে । দশানন নীরবে বিচরণ করছেন ঘরে । আজ যেন তার কোন উদ্গ্রিবতা নেই । বরং তিনি অপেক্ষারত । হয়তো তিনি এটাও জানেন সকল কর্মের সকল অন্যায়ের নীরব প্রশ্রয় যেমন তিনি করেছেন ঠিক তেমনই অন্যায়ের সমালোচনা করেছেন তার স্বামীর কাছে একান্তে । মন্দোদরী স্বৈরিণী যে নন তা সকল লোকের সকলেই অবহিত ।
লঙ্কার কাননে সবে দুয়েকটা পাখী ডেকে উঠেছে । সমুদ্রতটে দশানন স্ত্রীর হাতের উপর হাত রেখে বললেন , “ আমি জানি তোমার মনে অসংখ্য প্রশ্ন । কিন্তু সময় কোথায় সকলের উত্তর দেওয়ার । তাও যুদ্ধে যাওয়ার আগে বলি , এটাই আমার অন্তিম যাত্রা । আর হয়তো দেখা হবে না ।“
মন্দোদরী আঁতকে উঠলেন । তিরতির করে কেঁপে উঠলো তার দুই ঠোঁট । একে একে তিন পুত্র অতিকায় , অক্ষয়কুমার্ , ইদ্রজিতের মৃত্যুর পর এই বিশালাকার পুরী খাঁ খাঁ করছে । পুত্র-পুত্রবধূদের চিতার আগুন এখনো জ্বলছে । আর একী বলছেন বীর দশানন !! বিহবলিত চোখে তাকিয়ে থাকেন দশাননের দিকে ।
দশানন উদয়মান সূর্যের দিকে তাকিয়ে বললেন , “ দেবী আমি অভিশপ্ত বিজয় । হ্যাঁ , বিষ্ণুভক্ত বিজয় । মনে পরে কী বলেছিলেন শুক্রাচার্য । শ্রীরাম বিষ্ণুর অবতার । অভিশপ্ত হয়ে আমি যখন কাতর হয়ে পরি তখন সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা বলেছিলেন , একমাত্র মুক্তির উপায় যখন বিষ্ণুর হাতেই আমার মৃত্যু হবে এ জন্মে । তাই আমি সব জেনেই তোমার কন্যা-পুত্র-অনাচার সকল কিছুই করতে থাকি । আজ সেই ক্ষণ । আমি জানি আজই আমার সেই পুণ্য লগ্ন । আজই যাবো চিরতরে আমার উপাস্য দেবতার বৈকুণ্ঠ ধামে ।“
এত বলে রাবণ চুপ করে গেলেন । ঊষা থেকে প্রভাত এখন । বাতাস মৃদুমন্দ ছন্দে বয়ে চলেছে । মন্দোদরী থেমে থেমে বললেন , “ স্বামী আমার কী দোষ ছিল ? কেন তুমি স্বার্থপরের মত তোমার সকল কুকর্মের অংশীদার করলে ? এটাই কী বিবাহের তাৎপর্য ? হায় যদি আগে জানতাম...! আমি কী পেলাম ।
মন্দোদরীর স্নিগ্ধ হাহাকারে কঠোর পাষাণ গলে যেমন যায় ঠিক সেদিনও বীর দশানন-দশগ্রীব রাবণের দুই চোখের কোনা সিক্ত হয়ে উঠেছিল ।
রাবণ বললেন , “ তাই তো তুমি রমনী শ্রেষ্ঠ , তাই তো তুমি নারী । তাই তো তুমি আমার মুক্তির কাণ্ডারি ।“
“ আমি কী নিয়ে থাকবো প্রভু ? “
“আমার চিতা নিভবে না কোন দিন দেখে নিও । তুমি আজীবন সধবা থাকবে । জানি , এতে তোমার প্রতি সঠিক বিচার হবে না । তবে মন্দোদরী তোমার ত্যাগ- আদর্শ যতদিন এই জগত থাকবে ততদিন তুমি কোন না কোন ভাবে মানব-দেব-যক্ষ-দানব সকলের কাছে অমর হয়ে থাকবে । তুমিই হবে জগতের দিক পরিচালিকা শক্তি ।।“ ( সমাপ্ত )
অবশেষে ত্রিকূট পাহাড়ের চূড়ায় যে অন্তিম রশ্মি লেগেছিল , তাও একটু একটু করে অনেক আগেই নিভে গেছে । লঙ্কাপুরীর মশালে যে কটা ক্ষীণ আলো শেষ নিঃশ্বাসের মত বুকের জোর দেখাচ্ছিল , তাতেই উজ্জ্বল এক স্বর্ণ আলোর বিচ্ছুরণ জানিয়ে যাচ্ছে দশগ্রীব এখনো রাজসভায় রত্ন সিংহাসনে । তবে একা , সম্পূর্ণ বান্ধবহীন । মুখে বিষাদের মধ্যেও কোথাও যেন জয়লাভের আস্বাদন । এ অভিব্যাক্তি একান্তই যেন তার ।
আগেই বিদায় করেছেন চামরধারীদের । কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছে মহামহিম দশগ্রীব শান্ত হচ্ছেন । দৃঢ় প্রত্যয় তার প্রতি রন্ধ্রে জেগে উঠছে । অকস্মাৎ দুই হাতে তালি দিয়ে উঠলেন । রাতের নির্জনতায় সোনার লঙ্কায় প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠলো সে শব্দ ।
ত্রিকূট পাহাড়ে যে ময়ূর ময়ূরী রাতের ক্লান্তির ঘুম দিচ্ছিল , সন্তান হারা প্রজারা অগ্নিকুণ্ডের সামনে নীরবে চোখের জল ফেলছিল , অশোকবনে যে চেরিরা পাহারা দিয়ে চলেছে দেবী সীতাকে , যে নদী ছলছল কলকল রবে সোনার লঙ্কার যুদ্ধ ক্ষেত্রের পাশে নানা স্মৃতি বহন করতে করতে দেশ থেকে দেশান্তরে অথবা ভারত মহাসাগরে গিয়ে মিশছে , ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে থাকলো ।
মহারাজার গম্ভীর আর্তরব শুনেছে আগেও তারা , যখন , দৈত্যরাজকন্যা পুষ্পৎকটার রূপে মুগ্ধ হয়ে মহর্ষি পুলস্তের পুত্র বিশ্রবাঃ তাকে দশদিন ধরে সম্ভোগ করেন এবং অবলা সেই পুষ্পৎকটা জন্ম দিয়েছিলেন রাবণকে । জন্মকালে তার অতিমানবীয় বাল্য কান্না সর্বলোকে কম্পন সৃষ্টি করেছিল না জানি কী হয় এই ভয়ে ।
আর আজ এই গভীর রাতে সেইরকম ধ্বনি । যদিও এই ধ্বনির মধ্যে প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত , রাজা এখন রাজনর্তকীর নৃত্য দেখতে চান ।
লঙ্কেশের সভায় এখন মৃদঙ্গ-রুদ্রবীণা ইত্যাদি বাদকদল নর্তকীর পায়ে ছন্দ তুলে চলেছে । কিন্তু মন সায় দিচ্ছে না । ক্ষণিক আনন্দ দশাননের হৃদয়ে তুলছে না দীর্ঘ শান্তি । অবশেষে তিনি নীরবে সবকিছু ফেলে ধীর এক অপরিচিত লয়ে চললেন রাজ অন্তপুরে । যেখানে তার প্রিয় পত্নী দেবী মন্দোদরী রয়েছেন । কী জানি অসুররাজ ময়াসুর ও অপ্সরা হেমার কন্যা মন্দোদরী আজও সকল অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে অপেক্ষা করে আছেন কিনা !
এই প্রথম রাবণের বুকের এক অজানা জগতে ভয় হতে শুরু করল । দুই হাত দিয়ে চন্ধন কপাট খুললেন । ঘরের অন্দরে উজ্জ্বল দীপ অনেকটাই নিষ্প্রভ । সহচরী আজ আর নেই এই ঘরেও । সামনেই পরে রয়েছে রত্ন খচিত পালঙ্ক । মহিষী কোথায় ! মন্দোদরী কী তবে আজ তাকে ফেলে রেখে চলে গেছেন পিত্রালয়ে !
রাবণ সেই বিশাল পালঙ্কের একপ্রান্তে বসে পরলেন । কয়েক সের ওজনের স্বর্ণ -রত্ন বেষ্টিত বিশাল রাজমুকুট রাখলেন খুলে । তিনি বিশ্রাম চান । আগামী প্রভাতেই তার হয়তো মুক্তি । দুচোখে তার শ্রান্তির ঘেরাটোপ ।
“ রাজন , তুমি ঘুমাতে চাও ? কেন এই ঘুম তোমার চোখে আজ ! “ মন্দোদরীর আবেগহীন দৃঢ় কণ্ঠস্বরে মুখ তুলে চাইলেন লঙ্কেশ । মনে হল এ যেন তার প্রিয়সখী প্রানাধিক প্রিয় পত্নী মন্দোদরীর কণ্ঠস্বর নয় । এ যেন হিমালয়ের বুকে জমাট তুষার ভাঙনের নিনাদ ।
“ মন্দোদরী , আমি ক্লান্ত । হে শিব-স্বয়ম্ভু একটু ঘুম দাও এই দুই চোখে । “ রাবণের কণ্ঠে প্রথমবার আর্তির সাক্ষী থেকে গেল কেবল অন্তপুরে দীপ্যমান অগ্নি বর্তিকারা-প্রায় নিষ্প্রভ অগ্নি শিখারা ।
“ কিন্তু রাজা , তুমি কেবল নিজেরটাই ভেবে গেলে ! আমার অন্যায় কোথায় ? না না আমি তোমাকে ঘুমাতে দিতে পারি না । “
“ তুমি কী চাও মন্দোদরী ! তুমি কী চাও পরাজিত হই ? তুমি কী চাও কালের পৃষ্ঠায় লেখা হয়ে থাকুক যুদ্ধের আগে লঙ্কা অধিপতি রাবণ কেবল একবার দুই চোখের পাতা এক করতে চেয়েছিল , কিন্তু পারে নি ...। বল বল ...বল মন্দোদরী... “ শেষের দিকে রাবণের কণ্ঠস্বরে মনে হল লেগেছে সমুদ্র বাষ্পের মত একরাশ লবণাক্ত অজানা অভিমান ।
“ চমৎকার রাজা চমৎকার ! ওঠো ,চল । চল সমুদ্রতটে । এই অন্তপুর এখন আমার কাছে কেবলমাত্র জতুগৃহ । এখানকার বাগিচার পুষ্প , যা প্রতিদিন আমার পায়ে নুপুরের মত বেষ্টন করে থাকে , তারা যেন আজ আমার এই দেহে নাগপাশ । সারা শরীরময় বিষের জ্বালা । তুমি ওঠো রাজা ।“ মন্দোদরীর এই নিষ্পাপ আবেদনে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারলেন না রাজা দশগ্রীব ।
২
সেইদিন যেদিন লঙ্কার আকাশে একটা কালো শকুন অনেকটা নীচ দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল , যেদিন তার দুই পাখায় উচ্চারিত হচ্ছিল , ‘ হায় ইন্দ্রজিৎ হায় ইন্দ্রজিৎ ‘।
যখন লঙ্কায় আর্য রাম সীতাকে উদ্ধারের জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিলেন , সেইদিনই মেঘনাদ সুলোচনার কথা উপেক্ষা করেছিলেন ।
স্বামীকে কাতর স্বরে সুলোচনা বলেছিলেন , “ তুমি তো বলশালী , তবে কেন নিকুম্ভিলা যজ্ঞের আয়োজন । মন বড়ই চঞ্চল হয়ে উঠেছে ।“
মেঘনাদ মৃদু হেসে বলেছিলেন , “ প্রিয়ে অনার্য যে কম নয় তার প্রমাণ রেখে যাবো ইতিহাসের গর্ভে ।“
রাজমাতা মন্দোদরী বুঝেছিলেন পুত্রবধু সুলোচনার হৃদয়ে কেন এই ঝড়ের সংকেত । তিনি পরম স্নেহে বুকের মধ্যে আশ্রয় দিয়েছিলেন আরেক অবলা নারীকে ।
রাবণ লঙ্কা ছেড়ে তিন যোগ্য পুত্রের হাতে দায়িত্ব অর্পণ করে ত্রিলোক জয়ে বেরিয়েছিলেন । আর ঠিক তখনই লঙ্কার এক মনোরম উপবন নিকুম্ভিলায় মেঘনাদ অগ্নিষ্টোম, অশ্বমেধ, বহুসুবর্ণক, রাজসূয়, গোমেধ, বৈষ্ণব ও মাহেশ্বর নামে সাতটি যজ্ঞ সম্পাদনা করেন। এই যজ্ঞসমূহের ফলে তিনি শিবের কাছ থেকে কামগ স্যন্দন, তামসী মায়া, অক্ষয় ইষুধি ও আরো অনেক অস্ত্রশস্ত্র লাভ করেন।
যজ্ঞের কোন ত্রুটি রাখেন নি । পরম অনুশীলনে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন দেবকুল । আশীর্বাদও করেছিলেন ।
অবশেষে এক সন্ধ্যায় দিগ্বিজয় করে আনন্দ উল্লাস আর জয়ধ্বনির মাঝে খুলে যায় লঙ্কার তোরণ । তুরী ভেরী নানা বাদ্যের মাঝে লঙ্কাধিপতি প্রবেশ করেন মহলে । মন্দোদরী প্রথা মেনে রাজটীকা পরিয়ে দেন । পরম যত্নে ক্ষতে প্রলেপ দিয়ে দেন ।
ইদ্রজিত পিতাকে প্রণাম করে সেদিন সন্ধ্যায় ভেবেছিলেন অনেক আশিস করবেন রাবণ । কিন্তু হায় ইদ্রজিত , সে জানতো না বৈষ্ণব যজ্ঞ করার জন্য রাবণ অতিশয় বিরক্ত হয়ে তীব্র ধিক্কার করবেন ।
মা আবার অন্যদিকে রানী মন্দোদরী সে রাতে তাদের মাঝে অন্তরাল না হলে রাবণের কোপে ইদ্রজিত হয়তো ...!
নাহ । সেদিন মন্দোদরীর সামনে কিছুই আর করেন নি তিনি বরং ইন্দ্রজিতের মাথা যে পুরোহিত খেয়েছিলেন সেই শুক্রাচার্যকে বারবার ধিক জানিয়েছিলেন ।
রাবণ হয়তো জানতেন ,তাই তিনি বলে উঠেছিলেন উপস্থিত আচার্যের দিকে তাকিয়ে , “ আর কতদিন অসুরকুলের সর্বনাশের জন্য ছল পৌরোহিত্য করবেন ? দেবতারা নানা অস্ত্র দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু আপনিই বলুন তো যে অস্ত্রে আজ ইন্দ্রজিৎ সাজিয়ে তুলেছে তার অস্ত্রভাণ্ডার সেই অস্ত্রের আড়ালেই দেবকুল ওর মৃত্যুবাণ লুকিয়ে রেখে গেল কিনা ?“
বিস্মিত মন্দোদরী স্বামীর এরূপ কথায় । হাহাকার করে ওঠে তার বুক ।
করুণ আর্তি মেশানো স্বরে তিনিও বললেন , “ এ কী করলেন আচার্য ! আপনি আমার কথা , এক মায়ের কথা ভাবলেন না ? সুলোচনার কাছে এর উত্তর আপনি দিতে পারবেন তো ?”
স্থির থাকতে পারলেন না এই যুগপৎ আক্রমনে ।
কুপিত যজ্ঞের হোতা শুক্রাচার্য মন্দোদরীর দিকে তাকিয়ে কটাক্ষ করে রাবণকে শাপ দিয়ে বললেন , “ রাবণ যখন এতোটাই জেনে গেছো তখন এটাও শুনে রাখো তুমি তোমার জামাতার হাতেই নিহত হবে ।“
জামাতার হাতে !! এ যে বড় লজ্জার । দুর্ভাগা মন্দোদরী ! কতবার আর কতকাল সকল কলঙ্ক নিজের অস্তিত্বে ধারণ করেছেন ।
৩
এখন সিংহল দ্বীপে আছড়ে পরছে ঢেউ । সামনেই দিগন্ত বিস্তৃত ভারত মহাসাগর । রাতের সমুদ্র পাখীরা কীসের সন্ধানে তীক্ষ্ণ রবে রাতের গভীরতা বাড়িয়ে তুলেছেন । ক্লান্ত রাবণ রত্ন শয্যায় শায়িত । মন্দোদরী ধীরে ধীরে উঠে এলেন মণিময় গবাক্ষের কাছে ।
বাইরে সামুদ্রিক হাওয়া রেশমের মত কোমল চুলে আলপনা কেটে দিয়ে যাচ্ছে ।
‘ কী পেলাম এ জীবনে ! পরম জ্ঞানী , তপস্বী , শৈব স্বামী সব কী দিতে পেরেছেন ? হ্যাঁ হয়তো পেরেছেন । ‘ কথাগুলো ভাবতে ভাবতে তিনি বেরিয়ে এলেন রাজ অন্তপুর থেকে অশোকবনে । এখানে আসতে কোনদিনই বাধা কেউই দেন নি , দশগ্রীবও না । বরং মাঝেমধ্যে তিনিই বলতেন , “ যাও মন্দোদরী মেয়েটির কাছে যাও , দেখে এসো কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা ।“
‘ তবে কী স্বামী জানতে পেরেছেন সেই গোপন কথাটি ? ‘ আবার ভাবেন , ‘ সে কী করে সম্ভব ! সেই রাতে দাসী আর সেই তো গেছিল বাধ্য হয়ে বসুন্ধরার কাছে ‘।
মন্দোদরীর কমলের মত দুই চোখে অশ্রু জমতে থাকে ।
সীতা তখনও ঘুমিয়ে পরেন নি । বরং নিজের মায়ের চোখে জল দেখে আঁচল দিয়েই মুছিয়ে দিলেন মন্দোদরীর সকল ব্যাথা ।
হয়তো এক নারী আরেক নারীর কথা সহজে বুঝতে পারেন । এই দীর্ঘকাল অশোকবনে থাকার সময়ে মন্দোদরী যেমন জানিয়েছিলেন যে তিনিই সীতার হত ভাগ্য মা তেমন এটাও বলতে ভোলেন নি রাবণের অপকর্মের কাহিনী ।
তিনি বলেছিলেন , “ সীতা জানি না আমি ভুল করেছিলাম কিনা ! জানি না দৈব শাপের হাত থেকে মুক্ত করাবার জন্য এ ঘটনা ঘটে চলেছে কিনা ! তাও , আমি কী করে ভুলি , যে আমি যে স্বামীকে পুজো করি , শ্রদ্ধা করি সেই দশাননই লোভের বশবর্তী হয়েছিলেন ।“ আজকের রাতের মত সেদিনও মাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিজের হৃদ স্পন্দনের সাথে মায়ের স্পন্দন অনুভব করেছিলেন সীতা প্রথমবার ।
সে রাতেও মন্দোদরী সজল চোখে বলেছিলেন , “ মা লক্ষ্মী , তুই তো সকলই জানিস তাও বলি , রাবণ ঋষিদের হত্যা করে তাঁদের রক্ত একটি বৃহৎ কলসে সঞ্চয় করে রেখেছিলেন। ঋষি গৃৎসমদ দেবী লক্ষ্মীকে কন্যারূপে পাওয়ার জন্য তপস্যা করছিলেন। তিনি দর্ভ ঘাস থেকে দুগ্ধ সংগ্রহ করে তা মন্ত্রপূত করে একটি পাত্রে সঞ্চয় করছিলেন যাতে লক্ষ্মী সেখানে অবতীর্ণ হতে পারেন। “
মন্দোদরী ক্ষণিক কাল মৌন হলেন । দেবী সীতা হতভাগ্য নারী-মা’কে আরো কাছে টেনে নিলেন । কিছুটা শান্ত হলেন তিনি ।
পুনরায় বলেন , “ একেই বলে ভাগ্য । রাবণ এই দুগ্ধ ঋষিরক্তের কলসে ঢেলে দেন। ঋষিরক্তকে প্রচার করা হয় সকল বিষের চেয়েও বিষাক্ত ।
সেদিনই আমিই আর বেঁচে থাকতে চাই নি । অপকর্মে মর্মাহত হয়ে তাই এই বিষাক্ত রক্ত পান করে আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম । কিন্তু রক্ত পান করার ফলে গৃৎসমদ সঞ্চিত দুগ্ধের প্রভাবে গর্ভবতী হয়ে পরি । লক্ষ্মীরূপে তুই আমার গর্ভে প্রবেশ করিস।“
এই দীর্ঘ কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেই মন্দোদরী চুপ করে গেলেন ।
সীতা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খুবই ধীরে বললেন , “ আমাকে ভ্রূণ অবস্থায় কুরুক্ষেত্রের মাটির তলায় প্রোথিত করে দিলে । রাজা জনক সীতা বলে লালন-পালন করলেন ।“
খানিক চুপ থেকে সীতা বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করলেন , “ মা নারীরাই কেন এত ত্যাগ করবেন ? তুমি কেন আমাকে সরিয়ে দিলে তোমার বুক থেকে ? একটুও কাঁপল না হৃদয় ?”
এই তীব্র আঘাত যে আসবে তা জানতেন মন্দোদরী । প্রস্তুত ছিলেন তিনি । আজই শেষ রাত তার জীবনের । যে কথাগুলো এতকাল কাওকে বলতে পারেন নি , আজ সে সময় , সেই ক্ষণ উপস্থিত ।
তিনি দু’হাত দিয়ে চোখের জল মুছে বললেন , “ হয়তো আমি-তুই নারী বলেই এত দহন । যতবার দগ্ধ হয়েছি ততবার কঠিন হয়েছে সংকল্প । সীতা তুই ,রাবণ ও তাঁর বংশের ধ্বংসের কারণ হবি বলে ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছিল । তাই তোর পিতা রাবণের আদেশেই পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলাম ।“
সীতা বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন , “ পিতা কী জানতো না যে আমি তার একমাত্র কন্যা !!”
মন্দোদরী নীরবে মাথা নাড়িয়ে না জানালেন ।
তিনি স্থীর ভাবে বললেন , “ নাহ ! তিনি কেবল জানতেন তুই জারজ আর তার বংশের মৃত্যুর কারণ হবি , তাই...। তবে পরে হয়তো অনুমান করেছিলেন । তাই তো তোকে জগত লক্ষ্মীকে নিয়ে আসে রামের সাথে ছলনা করে ...। তিনি এখন বৃদ্ধ । সেজন্যই হয়তো তোকে কাছ ছাড়া করতে চান না ।“
৪
আকাশের পূর্ব কোণ ক্রমে রক্তিম বর্ণ হয়ে উঠছে । দশানন নীরবে বিচরণ করছেন ঘরে । আজ যেন তার কোন উদ্গ্রিবতা নেই । বরং তিনি অপেক্ষারত । হয়তো তিনি এটাও জানেন সকল কর্মের সকল অন্যায়ের নীরব প্রশ্রয় যেমন তিনি করেছেন ঠিক তেমনই অন্যায়ের সমালোচনা করেছেন তার স্বামীর কাছে একান্তে । মন্দোদরী স্বৈরিণী যে নন তা সকল লোকের সকলেই অবহিত ।
লঙ্কার কাননে সবে দুয়েকটা পাখী ডেকে উঠেছে । সমুদ্রতটে দশানন স্ত্রীর হাতের উপর হাত রেখে বললেন , “ আমি জানি তোমার মনে অসংখ্য প্রশ্ন । কিন্তু সময় কোথায় সকলের উত্তর দেওয়ার । তাও যুদ্ধে যাওয়ার আগে বলি , এটাই আমার অন্তিম যাত্রা । আর হয়তো দেখা হবে না ।“
মন্দোদরী আঁতকে উঠলেন । তিরতির করে কেঁপে উঠলো তার দুই ঠোঁট । একে একে তিন পুত্র অতিকায় , অক্ষয়কুমার্ , ইদ্রজিতের মৃত্যুর পর এই বিশালাকার পুরী খাঁ খাঁ করছে । পুত্র-পুত্রবধূদের চিতার আগুন এখনো জ্বলছে । আর একী বলছেন বীর দশানন !! বিহবলিত চোখে তাকিয়ে থাকেন দশাননের দিকে ।
দশানন উদয়মান সূর্যের দিকে তাকিয়ে বললেন , “ দেবী আমি অভিশপ্ত বিজয় । হ্যাঁ , বিষ্ণুভক্ত বিজয় । মনে পরে কী বলেছিলেন শুক্রাচার্য । শ্রীরাম বিষ্ণুর অবতার । অভিশপ্ত হয়ে আমি যখন কাতর হয়ে পরি তখন সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা বলেছিলেন , একমাত্র মুক্তির উপায় যখন বিষ্ণুর হাতেই আমার মৃত্যু হবে এ জন্মে । তাই আমি সব জেনেই তোমার কন্যা-পুত্র-অনাচার সকল কিছুই করতে থাকি । আজ সেই ক্ষণ । আমি জানি আজই আমার সেই পুণ্য লগ্ন । আজই যাবো চিরতরে আমার উপাস্য দেবতার বৈকুণ্ঠ ধামে ।“
এত বলে রাবণ চুপ করে গেলেন । ঊষা থেকে প্রভাত এখন । বাতাস মৃদুমন্দ ছন্দে বয়ে চলেছে । মন্দোদরী থেমে থেমে বললেন , “ স্বামী আমার কী দোষ ছিল ? কেন তুমি স্বার্থপরের মত তোমার সকল কুকর্মের অংশীদার করলে ? এটাই কী বিবাহের তাৎপর্য ? হায় যদি আগে জানতাম...! আমি কী পেলাম ।
মন্দোদরীর স্নিগ্ধ হাহাকারে কঠোর পাষাণ গলে যেমন যায় ঠিক সেদিনও বীর দশানন-দশগ্রীব রাবণের দুই চোখের কোনা সিক্ত হয়ে উঠেছিল ।
রাবণ বললেন , “ তাই তো তুমি রমনী শ্রেষ্ঠ , তাই তো তুমি নারী । তাই তো তুমি আমার মুক্তির কাণ্ডারি ।“
“ আমি কী নিয়ে থাকবো প্রভু ? “
“আমার চিতা নিভবে না কোন দিন দেখে নিও । তুমি আজীবন সধবা থাকবে । জানি , এতে তোমার প্রতি সঠিক বিচার হবে না । তবে মন্দোদরী তোমার ত্যাগ- আদর্শ যতদিন এই জগত থাকবে ততদিন তুমি কোন না কোন ভাবে মানব-দেব-যক্ষ-দানব সকলের কাছে অমর হয়ে থাকবে । তুমিই হবে জগতের দিক পরিচালিকা শক্তি ।।“ ( সমাপ্ত )
0 comments
Add your comment here
Use the following form to leave your comment on this prose
Statistics
Number of VISITORS | 28790 |
Number of REGISTERED USERS | 4961 |
Number of Writers | 2122 |
Total Number of Poems | 3 |
Total Number of Prose | 17 |
Search
Writers’ list
" সুদীপ্ত মণ্ডল (SUDIPTA MONDAL) "
স্বরূপ মুখার্জ্জী (Swarup Mukherjee)
Bhaswati Banerjee Roychowdhury
Dr. Pinki Purkayastha Chandrani
Dr. Satyadarshi Roy, A Homoeopathy Consultant
KOUSHIKA CHAKRABORTY MUKHERJEE
Paromita Raha Halder ( Bijoya)
Paromita Raha Halder ( Bijoya)
Prithwish Datta (পৃথ্বীশ দত্ত)
Romi Roy Chowdhury Chakraborty
SHARADINDU CHAKRABORTY শরদিন্দু চক্রবর্তী
Sonali Bhattacharyya Mukherjee
subarnarekha dhar (chatterjee)
Subhasree Bhattacharjee (শুভশ্রী ভট্টাচার্য্য)
SUMANTA BHOWMICK - সুমন্ত ভৌমিক
প্রসেনজীত কর মালাকার (রাতের আঁধার)
শাহীনূর মুস্তাফিজ(বিপ্লবী কবি)